
ভূমিকাঃ
Youtube Income বা ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয় বর্তমানে একটি আকর্ষনীয় অনলাইনে আয়ের মাধ্যম। তবে ব্যাপারটা নিয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যে রয়েছে অনেক ভুল ধারণা। ইউটিউবের মালিকানা প্রতিষ্ঠান গুগল যাকে আদর করে বিগ জি বলা হয়, Youtube Income বা ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয়ের বিষয়টাকে তার অন্যান্য ব্যবসায়ের মতই বিভিন্ন দিক থেকে নিশ্ছিদ্র করে রেখেছে। সাধারণ মানুষ এসব বিষয়গুলো জানেনা বলেই একদল ঠগ-প্রতারক-জোচ্চর মানুষ ইউটিউব থেকে টাকা আয়ের মত আকর্ষনীয় একটি মাধ্যমকে নিজেদের ব্যবসায় বানিয়ে ফেলেছে। ফলাফল – সাধারণ মানুষ যারা অনলাইন থেকে নিজেদের Youtube Income বা ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয় করতে চায় তারা বিভিন্নভাবে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অল্পদিনের মধ্যেই ইউটিউব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এতে গুগলের তো তেমন ক্ষতি হচ্ছে না কিন্তু বাংলাদেশের মত সম্ভাবনাময় একটি দেশের সম্ভাবনাময় একটি অনালাইন আয়ের খাত ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। ঠগ-জোচ্চরদের পাল্লায় পড়ে এ দেশের বেশিরভাগ নতুন ইউটিউবাররা এমনসব হাস্যকর পদ্ধতির আশ্রয় নিচ্ছেন যাতে করে গুগলসহ অন্যান্য অনলাইন ইনকামের সুযোগ দানকারী প্রতিষ্ঠানের চোখে বাংলাদেশ হয়ে পড়েছে একটি অলাভজনক দেশ। এর ফলে দেশে পেপাল ঢুকতে পারছে না, অধিকাংশ অনলাইন ইনকাম টুল্সের ব্যবহারকারীদের লিস্টে বাংলাদেশের নামই নেই, এমনকী গুগল সার্চ কনসোলে পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যবহার করে অনেক ফিচার ব্যবহার করা যায় না।
এক্ষেত্রে যেমন ঠগ-জোচ্চররা দায়ী, তেমনি দায়ী সফল ইউটিউবাররা যারা নিজেদের চ্যানেল নিয়েই এত ব্যস্ত যে এমন সম্ভাবনাময় একটি খাতকে দেশের বেকার সমাজকে ব্যবহারের জন্য তৈরি করতে পারছে না। দায়ী দেশের সরকারও যারা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন তো দেখাচ্ছেন কিন্তু অনলাইন ইনকামের জন্য প্রয়োজনীয় জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। আবার যারা কষ্ট করে বিভিন্ন পথ ঘুরে ইনকামের পথ করে নিয়েছে তাদের আয়ে ঠিকই ভ্যাট/ট্যাক্স বসিয়ে চলেছে।
অথচ পাশের দেশ ভারতকে দেখুন। দু’দেশের সাধারণ মানুষের টেকনোলজিক্যাল জ্ঞানের তুলনা করলে বাংলাদেশের তরুণরা কোনভাবেই ওদেশের তরুণদের থেকে কম যায় না। কিন্তু ভুল জ্ঞান, সুযোগ-সুবিধার অভাব, সহযোগিতার অভাবে ভারত থেকে কয়েকগুণ পিছিয়ে আমাদের অনলাইন আয়ের খাত। অথচ ভালভাবে তাকালে দেখবেন – এত কষ্টের মধ্যেও কয়েকজন কিন্তু দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। টেন মিনিট স্কুল, পাগলা ডিরেক্টর (কাইশ্যা), সোহাগ ৩৬০, ফানি ফ্রগ ক্রিয়েটিভ্স, আলোর পথ, ফারজানা ড্রয়িং একাডেমি, আমি বাবু, মিস্ট্রিজ ওয়ার্ল্ড নলেজ – এই ইউটিউব চ্যানেলগুলো কিন্তু আমাদের মত তরুণদেরই তৈরি।
সমাধানঃ

এবার আসুন মূল বিষয়ে- কিভাবে ইউটিউব চ্যানেল থেকে ইনকামকে সহজ করা যায়। আমরা কয়েকটি ধাপে সমাধানগুলো নিয়ে আলোচনা করব। সবার আগে দরকার ভুল ধারণাগুলো ভাঙ্গানো। এসব ভুল ধারণাকে পুঁজি করেই ঠগ-জোচ্চররা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে।
দ্বিতীয় ধাপে প্রয়োজন হবে সঠিক পথে অল্প আয়াসে কিভাবে Youtube Income বা ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয় করা যাবে সে বিষয়ে ফ্রি প্রশিক্ষণ। এরপর থাকবে টেকনোলজিকাল জ্ঞান ও টুল্সের ব্যবহার করে চ্যানেল প্রমোট করা। এবং সবার শেষে প্রয়োজন হবে সরকারি সহযোগিতা।
১ম ধাপঃ Youtube Income বা ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয় সম্পর্কিত মিথ/ভুল ধারণা
আসুন কিছু প্রশ্নোত্তরের খেলার মাধ্যমে বিষয়গুলো পরিস্কার করি।
প্রশ্নঃ গুগল কেন আপনাকে টাকা দেবে?
উত্তরঃ আমার চ্যানেলে ওদের বিজ্ঞাপনদাতারা অ্যাড দিবে।
প্রশ্নঃ অ্যাড কেন/কিভাবে দিবে?
উত্তরঃ আমি ওদের পার্টনারশিপ প্রোগ্রামে কোয়ালিফাই করেছি। আমার ১০০০ সাবস্ক্রাইবার আর গত ১২ মাসে ৪০০০ ঘন্টা ওয়াচটাইম আছে। তাই ওরা অ্যাড দিবে।
প্রশ্নঃ ১০০০ সাবস্ক্রাইবার আর গত ১২ মাসে ৪০০০ ঘন্টা ওয়াচটাইম কিভাবে ম্যানেজ করেছেন?
উত্তরঃ সাব ফর সাব ব্যবহার করেছি। সাবস্ক্রাইব ও ওয়াচটাইম কিনেছি। শেয়ার করেছি।
প্রশ্নঃ কতজনকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছেন?
উত্তরঃ ৫০/১০০/১০০০। ওদের ৫/১০/৫০টা করে জি-মেইল আছে।
প্রশ্নঃ বেশ। মনেটাইজ তো পেয়েছেন। এবার ভিডিওতে অ্যাড দিবেন। ভিডিও/অ্যাড কারা দেখবে? এটাও কি কিনবেন? কিনে পোষাতে পারবেন তো?
উত্তরঃ ইয়ে…মানে…ইয়ে
প্রশ্নঃ অ্যাডসেন্স কিভাবে, কিসের উপর ভিত্তি করে অ্যাড দেয় জানেন?
উত্তরঃ না।
প্রশ্নঃ গুগল যেকোন মুহুর্তে আপনার অলাভজনক চ্যানেল সাস্পেন্ড করে দিতে পারবে, জানেন?
উত্তরঃ না।
প্রশ্নঃ রিটার্নিং সাবস্ক্রাইবার না হলে গুগল যে আপনার চ্যানেল থেকে সাবস্ক্রাইবার মুছে দিতে পারে সেটা জানেন তো?
উত্তরঃ না।

তাহলে এ লাইনে কেন এসেছো বাবা??!!
গুগল আপনাকে টাকা দিবে কারণ আপনি তার বিজ্ঞাপনদাতার জন্য দর্শক জোগাড় করে দিবেন। তারমানে এখানে মূল প্রোডাক্ট হচ্ছে আপনার চ্যানেলের ভিউয়াররা। আপনি এখান সেখান থেকে ভাড়া করে ভিউয়ার নিয়ে আসতেছেন, টাকা দিয়ে ওয়াচটাইম কিনতেছেন, ১০/২০টা জিমেইলধারী একই আইপি অ্যাড্রেস ও মেশিন আইডি/ম্যাক অ্যাড্রেস থেকে আপনার চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করে জীবনে ২য় বার আর আপনার চ্যানেলের টিকিটিও দর্শন করতে আসছে না- এমন প্রোডাক্ট আপনি গুগলের কাছে বিক্রি করবেন আর বিগ জি আপনাকে হাসতে হাসতে ডলার ছুড়ে মারবে? যদি তাই মনে করেন তাহলে বলব আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তাহলে কিভাবে বাড়াবেন ভিউয়ার? ওয়াচটাইম? সাবস্ক্রাইবার? এর সবচেয়ে সহজ উত্তর হচ্ছে ধৈর্যের সাথে ভাল মানের কন্টেন্ট তৈরি করতে হবে। চাহিদা রয়েছে এমন কন্টেন্ট বানাতে হবে। তবেই পাবেন অর্গানিক ভিউয়ার।

তবে অন্য পথও রয়েছে। যেভাবে পার্শ্ববর্তী দেশের শত-শত ইউটিউবাররা তাদের Youtube Income বা ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয় করছে। ওদের রয়েছে অনেক শক্তিশালী একটা নেটওয়ার্ক। সে নেটওয়ার্কে রয়েছে লক্ষ লক্ষ ইউজার। অর্গানিক ইউজার। আপনি নিজেও হয়তো এমন অনেক নেটওয়ার্কে জড়িয়ে আছেন, জানেনই না। নিজের খেয়ে নিজের পড়ে পাশের দেশের একজন ইউটিউবার কে মাসিক আয়ের পথ করে দিচ্ছেন নিজেরই অজান্তে। এতে আপনার দোষ নেই বরং ওদের অসাধারণ টেকনিকই আপনাকে ওদের হয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। এ নিয়ে বিস্তারিত পরে বলব।
এবার মিথগুলো সংক্ষেপে বলে যাইঃ
- একাধিক জি-মেইল থেকে সাবস্ক্রাইব করা হলেই সেটা জেনুইন সাবস্ক্রাইব হয় না। গুগলের অ্যালগরিদম অনুযায়ী – একটা আইপি ও ম্যাক অ্যাড্রেস থেকে একটাই সাবস্ক্রাইবার ধরা হয়। এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন – একই আইপি অ্যাড্রেস শেয়ার করে তো অনেকগুলো ডিভাইস ব্যবহার করা যায়। বা একটি ডিভাইস থেকেও অনেক ইউজার ভিন্ন ভিন্ন গুগল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারে। ওগুলো কি জেনুইন সাবস্ক্রাইবার নয়? আমি বলব – হ্যা ,অবশ্যই। কিন্তু সেখানেও গুগল ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট ব্রাউজিং হিস্ট্রি/কুকিজ বিভিন্ন তথ্যের সহায়তায় একটা প্যাটার্ন বের করবে যে আপনি কি ভুয়া ইউজার নাকি জেনুইন। ধরে নিন আপনার বাসায় আপনি আর আপনার বোন একই ডিভাইস (ডেস্কটপ/ল্যাপটপ ইত্যাদি) থেকে ইউটিউব ব্রাউজ করেন। আপনাদের ব্রাউজিং প্যাটার্ন কিন্তু একজনের সাথে আরেকজনেরটা মিলবে না। কিন্তু আপনি যদি নিজেই ২টা আলাদা আলাদা জিমেইল থেকে ইউটিউব ব্রাউজ করেন তবে প্যাটার্ন মিলে যাবে। গুগল তার অ্যালগরিদম ১দিনে বানায় নি। অতএব এখানে চালাকির সুযোগ খুবই কম।
- একটি জি-মেইল থেকে সাবস্ক্রাইব শেয়ার করা হলেও সেটা যদি রিটার্নিং সাবস্ক্রাইব না হয় তবে গুগল কোন এক সময় আপনার এই সাবস্ক্রাইবারকে চ্যানেল থেকে রিমুভ করে দিবে। এ ধরণের সাবস্ক্রিপশন সফ্টওয়্যার বা বট ব্যবহার করেও করা যায়। ফলে গুগল এটাকে স্প্যামিং হিসেবে রিমুভ করে দেয়। তার মানে এই দাড়াচ্ছে, যার সাথে সাবস্ক্রিপশন শেয়ার করছেন সে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপনার চ্যানেলে ২য় বার না ঢুকলে ঐ সাবস্ক্রিপশন বাতিল।
- ওয়াচটাইম কাউন্টের ক্ষেত্রেও গুগলের পলিসি রয়েছে। ধরুন আপনার একটি গেমিং ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। আপনি কোন না কোন ভাবে জেনুইন একজন ভাই-ব্রাদার জোগাড় করে ফেললেন যে প্রতিদিন রুটিন করে আপনার চ্যানেলের ভিডিও দেখবে ১ ঘন্টা। সে দেখলও। কিন্তু সে বেচারা হিন্দি গানের ফ্যান। আপনার গেমিং চ্যানেল ছাড়া জীবনে সে আর কোন গেমিং চ্যানেলে ঢুকেই নাই। তো বিগ জি-র অ্যালগরিদমে এই ভিউয়ার আপনার জন্য ভুয়া ভিউয়ার। তার দেখা ওয়াচটাইম আপনার টোটাল ওয়াচটাইমে যোগ হলেও গুগল সেটা কাউন্ট করবে না।
- ১০০০ সাবস্ক্রাইবার ও ৪০০০ ঘন্টা ওয়াচটাইম আসলে একটা ছোট্ট সিড়ি। এটা পার হলেই আসল চড়াই-উৎরাই শুরু। অধিকাংশ ইউটিউবার এই ধাপ থেকেই ছিটকে পড়েন। ইউটিউব থেকে বিভিন্ন উল্টা-পাল্টা মেইল আসা শুরু হয়ে যায় – আপনার মনেটাইজেশন রদ করা হয়েছে বা চ্যানেল বাতিল করা হয়েছে, কম্যুনিটির নিয়ম ভংগ করছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ পর্যায়ে ইউটিউব পলিসিগুলো সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান খুবই জরুরী। এবং ভাল কথা – এই জ্ঞান কিন্তু বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না।
- Youtube Income বা ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয়ের অনেকগুলো উৎস রয়েছে এবং তার মধ্যে সবচেয়ে নিম্নমানের মাধ্যম হচ্ছে গুগল অ্যাডসেন্স। চমকে গেলেন? না এটাই সত্য। ইউটিউবারদের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হচ্ছে স্পন্সরশিপ। প্রচুর অডিয়েন্স না থাকলে অ্যাডসেন্স থেকে বাংলাদেশে বসে আপনি যা আয় করবেন, যেটা দিয়ে আপনার প্রোডাকশন কস্ট উঠাতেই খবর হয়ে যাবে। এজন্য প্রয়োজন ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি, টেকনোলজিকাল টুল্স ও সেগুলো ব্যবহারের জ্ঞান।
- এসব ধাপ পার হলেই শেষ নয়। এবার পালা চ্যানেল রক্ষার। একটি সফল ইউটিউব চ্যানেল মানেই হ্যাকারদের চোখের মণি। চ্যানেল সিকিউরিটির বিষয়গুলো জানা না থাকলে, কখন কিভাবে যে চ্যানেল হ্যাক হয়ে যাবে কল্পনাও করতে পারবেন না।
(চলবে – পরবর্তী কিস্তিতে থাকছে ২য় ধাপের আলোচনা)
** নতুন ইউটিউবারদের নিয়ে আমাদের একটি আলাদা প্রয়াস চলছে। সেই কম্যুনিটিতে চাইলে আপনিও অংশ নিতে পারেন। যোগ দিতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।